সালাতের নৈতিক শিক্ষা (পাঠ ১৩)

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা - ইবাদত | NCTB BOOK
1k
Summary

সালাতের নৈতিকতা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:

সালাত (নামায) ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত, যা নৈতিকতার উন্নতি ঘটাতে সহায়তা করে। নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর আইন পালন হওয়ার পাশাপাশি মানুষের পার্থিব জীবনেও নৈতিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। এখানে নামাযের কিছু মূল নৈতিক বিষয় উল্লেখ করা হলো:

  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: নামায আদায়কারীকে পরিষ্কার থাকতে হয়। নামাযের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন, যেমন ওয়জু করা।
  • সময়ানুবর্তিতা: নামায নির্ধারিত সময়ে আদায় করা মুমিনকে সময়ের প্রতি সচেতন করে। জামাআতে নামাযের সময়মত উপস্থিতি নিশ্চিত করে সময়ের সদ্ব্যবহার।
  • শৃঙ্খলা: নামাযের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা শিক্ষা পাওয়া যায়। এক কিবলার দিকে মুখ ফেরানো এবং একই ইমামের পিছনে দাঁড়ানো শৃঙ্খলার উদাহরণ।
  • একাগ্রতা: নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য একাগ্রতার প্রয়োজন। বিনয়ের সাথে নামাযে দাঁড়ানো আবশ্যক।
  • নিয়মানুবর্তিতা: সালাত মানুষের মধ্যে নিয়ম মানতে অভ্যস্ত করে, যা সমাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
  • সাম্য: জামাআতে নামায মুসলিমদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য দূর করে এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এসকল নৈতিক বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সালাত (নামায) ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর সাথে নৈতিকতা বিষয়টি বিশেষভাবে জড়িত। ইসলামি বিধান অনুযায়ী নামায আদায় করলে একে তো আল্লাহর আইন পালন করা হয়, অপরদিকে বান্দার পার্থিব জীবনেও নৈতিকতার উন্নতি ঘটে। আর কোনো মানুষের নৈতিকতার উন্নতি ঘটলে, দুনিয়াতে যেমনি পাবে সম্মান ও মর্যাদা তেমনি পরকালেও পাবে সুখ-শান্তি।
নিচে নামাযের কতিপয় নৈতিক বিষয় বর্ণনা করা হলো:

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
নামায আদায়কারীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে একজন মুমিন যখন নামায আদায় করবে তখন তাকে অবশ্যই ওযু করতে হয়। আর নামাযের পূর্বশর্তসমূহের একটি হলো পবিত্রতা অর্জন করা। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاظَهَرُوا

অর্থ: "যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে পবিত্রতা অর্জন কর।" (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৬)
নামাযের আগে রাসুলুল্লাহ (স.) মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যথানিয়মে দাঁত পরিষ্কার করলে মুখে দুর্গন্ধ থাকে না। রোগের আশঙ্কা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। তিনি বলেন, 'আমার উম্মতের উপর কষ্টকর না হলে আমি তাদের প্রতি নামাযে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।' (ইবনু মাজাহ)
নামায আদায় করতে হলে দৈনিক পাঁচবার ওযু করতে হয় যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় অঙ্গকে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করে। এটা নাক, মুখ, চোখ, দাঁত ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখার অতুলনীয় কৌশলও বটে। যদি মুসল্লির শরীর, জামাকাপড় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে তাহলে অন্য মুসল্লির কষ্ট হয় না। বরং সুন্দর ও সুস্থ মন নিয়ে একে অপরের সাথে দাঁড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এ শিক্ষা নামায থেকেই পাওয়া যায়।

কাজ: শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক দল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জনে সালাতের ভূমিকা বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করে শ্রেণিতে উপস্থাপন করবে।

সময়ানুবর্তিতা
নামায নিয়মানুবর্তিতা ও সময়নিষ্ঠা শিক্ষা দেয়। একজন মুমিন ব্যক্তিকে দৈনিক পাঁচবার নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করতে হয়। এতে সে সময়ের প্রতি সচেতন হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে জামাআতে নামায অনুষ্ঠিত হয়। কোনো ব্যক্তি সময়মতো জামাআতে নামায আদায় করতে না পারলে সে জামাআতের সাওয়াব হতে বঞ্চিত হবে। কিছু সময় পরই নামায আদায় করতে হয় বলে সময়কে শিথিল করা যায় না। বরং সবসময়ই নামাযের আহবানে সাড়া দেওয়ার জন্য মুমিন ব্যক্তিকে প্রস্তুত থাকতে হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

إِنَّ الصَّلوةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَبًا مَّوْقُوتًا

অর্থ: "নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।" (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩)

প্রতিদিন পাঁচবার নির্ধারিত সময়ে জামাআতে নামায আদায় করা মুমিন বান্দাকে সময়নিষ্ঠ হতে এবং সময়ের প্রতি গুরুত্ব উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করে। অকারণে তিনি সময় নষ্ট করেন না। সমাজের অপরাপর লোকের সাথে সময়মতো কর্তব্য কাজে অভ্যস্ত হন।

এতে সে জীবনের সব কাজেই সময়নিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। প্রত্যেক মুসলিম দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের মাধ্যমে সময়নিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ হলে সে অবশ্যই একটি জাতির অমূল্য মানবসম্পদে পরিণত হবে। সময়মতো নামায আদায় করার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার কর্মস্থলে যথাসময়ে কর্তব্য পালনের শিক্ষা গ্রহণ করবে। সে কোনো কাজ আগামী দিনের জন্য ফেলে রাখবে না। বরং যথাসময়ে কঠোর পরিশ্রমে ঐ কাজ সম্পন্ন করবে। দেশের সেনাবিভাগ কঠোর সময়ানুবর্তিতার দিকে মনোনিবেশ করে। এ বিভাগে কর্তব্যরত সৈনিকগণকে নির্ধারিত সময়ে বিউগল বেজে উঠলে শয্যা ত্যাগ করে ইউনিফর্ম পরিধান করে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ বা কাজে অংশগ্রহণ করতে হয়। দেশ রক্ষা ও শত্রুদের সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলার জন্যই সৈন্যদেরকে এরূপ শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ তাদের জীবনে এরূপ দুঃসময় নাও আসতে পারে। কিন্তু মুসলিমগণ অবিরত তাদের কর্তব্য পালনে নিয়োজিত। তাদের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অসৎ ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তাদের সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে। মহান আল্লাহ দৈনিক পাঁচবার তাঁর মুমিন বান্দাকে আযানের মাধ্যমে নামাযের আহবান জানান। এ আহবানে আল্লাহর সৈনিকগণ দৌড়ে আসবে এবং প্রমাণ করবে, সবসময় ও সকল অবস্থায় তারা আল্লাহর হুকুম পালনে প্রস্তুত।

কাজ : 'সময়ানুবর্তিতাই মানুষের ইহজীবনে সম্মান বাড়ায়'- এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে বিতর্কের আয়োজন করবে।

শৃঙ্খলা
শৃঙ্খলা মানে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের জীবনে শৃঙ্খলার গুরুত্ব অপরিসীম। রাস্তাঘাটে যানবাহন চালনায় চালককে যেমন একটি বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। আর এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। তেমনি মানুষের জীবনও একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির অধীনে আবদ্ধ। বিশৃঙ্খলভাবে জীবন পরিচালনা করলে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। আর যদি সুশৃঙ্খলভাবে জীবন পরিচালনা করে তাহলে নিজে যেমন উপকৃত হবে তেমনি সমাজের অন্য ব্যক্তিও নিরাপদে থাকবে। শৃঙ্খলার এই শিক্ষা নামায থেকেই পাওয়া যায়।
নামাযে একাকী হোক আর জামাআতবদ্ধ হোক বান্দাকে এক কিবলার দিকেই মুখ ফেরাতে হয়। একই সময়ে নির্দিষ্ট নামায আদায়ের জন্য একই ইমামের পিছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হয়। এভাবে নামায আদায়ের ফলে মুমিনের মাঝে শৃঙ্খলাবোধ, নেতার প্রতি আনুগত্যবোধ গড়ে ওঠে। সমাজে কোনো সমস্যা দেখা দিলে, সকলে মিলেমিশে মীমাংসা করার শিক্ষা নামাযের মাধ্যমে লাভ করা যায়।

কাজ: নামায আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষ তার কর্মস্থলেও সুশৃঙ্খল হয়, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা করবে।

একাগ্রতা
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করা। নামাযের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট তার আবেদন নিবেদন পেশ করে তৃপ্তি লাভ করতে পারে। আর আল্লাহ তায়ালাও বান্দার আবেদন গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে বান্দাকে অবশ্যই বিনয়ের সাথে নামাযে দাঁড়াতে হবে। যেমন: কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
"তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দাঁড়াবে।" (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৮)
নামায অবস্থায় বান্দার মন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে অথচ নামাযি টেরও পায় না। কারণ, মানব মন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। গভীর মনোযোগের সাথে কোনো কাজে নিয়োজিত না হলে মন স্থির থাকে না। তাছাড়া শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে বান্দার সকল ইবাদত বিশেষত নামায নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন বিষয় মনের মধ্যে হাজির করে দেয়। তাই বান্দার মন নামাযে ঠিক থাকে না। এজন্যই বান্দাকে খুশু খুযু (বিনয় ও একাগ্রতা) ও মনের স্থিরতার সাথে নামায আদায় করতে হবে। যেমন পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, "মুমিনগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়ী।" (সূরা আল-মু'মিনূন, আয়াত: ১, ২)

কাজ : 'একাগ্রতা হচ্ছে নামায কবুল হওয়ার একমাত্র উপায়।' শিক্ষর্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করবে।

নিয়মানুবর্তিতা
নামায মানুষকে নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। যে প্রশিক্ষণের মধ্যে মানবজাতির কল্যাণ নিহিত। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষ যা অর্জন করে তা নিচে বর্ণনা করা হলো:
১. মানুষ তার প্রভুর কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত হয়।
২. সমাজে কে অনুগত আর কে বিদ্রোহী নামায তা নির্ধারণ করে দেয়।
৩. মানুষকে ইসলামের পরিপূর্ণ আদর্শ মানব হিসেবে গড়ে তোলে এবং তাকে ইসলামের উপর সুদৃঢ় থাকতে সাহায্য করে।
৪. এটি বান্দার চারিত্রিক শক্তিকে আরও দৃঢ় করে।
নামায মানব চরিত্রের দুর্বলতা দূর করে। সাত বছর বয়সে ছেলেমেয়েদের নামাযের তাগিদ দিতে বলা হয়েছে। এতে তারা শিথিলতা করলে দশ বছর বয়সে তাদের প্রহার করে নামাযে অভ্যস্ত করে তোলার নির্দেশ রয়েছে। নামায আদায়ের দায়িত্ব হতে কেউ রেহাই পায় না। নামাযের সময় হলে সকল মুমিন ব্যক্তি সর্বাবস্থায় নামায আদায় করতে বাধ্য।
যে ব্যক্তি নিয়মনীতি মেনে, সময়নিষ্ঠ হয়ে একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করবে, সে অবশ্যই হবে একজন দায়িত্ব সচেতন, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। এমন ব্যক্তি সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

সাম্য
জামাআতে নামায আদায়কারী মুসল্লিগণ মসজিদে একত্র হয়ে একই কাতারে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হয়। সকল মুক্তাদিই ইমামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। তখন ধনী-গরিব, আমির-ফকির, শাসক-শাসিত, ছোটো-বড়ো ভেদাভেদ থাকে না। মসজিদে ইমাম মুয়াযযিন ব্যতীত অন্য কারো জন্য স্থান নির্ধারিত থাকে না। এটি ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যবাদের মূর্ত প্রতীক। সমাজে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। সামাজিক যেকোনো সমস্যা সমাধানে একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসে এবং শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে সক্ষম হয়।
সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের এ শিক্ষা একজন মুমিনকে সমাজের অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, দায়িত্বশীল ও সহযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন করে গড়ে তোলে। এতে সমাজে ছোটো-বড়ো, ধনী-গরিব শ্রেণিবৈষম্য ইত্যাদি দূর হয় এবং অতুলনীয় সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এর ফলেই সমাজে কোনো রকম কলহ-বিবাদ থাকতে পারে না। বরং প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আদর্শ সমাজ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে নামায থেকে নিয়মানুবর্তিতা ও সাম্যের যেসব শিক্ষা পাওয়া যায়-তার তালিকা প্রণয়ন করবে।

Content added By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...